ডেস্ক রিপোর্ট: কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি এ (স্নাতক) পাস করে ঢাকায় এসে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন ঢাকায় থাকার জন্য তেমন কোনও জায়গা ছিল না তাঁর। কলকাতা থেকে ট্রেনে এসে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীর তৎকালীন দলীয় কার্যালয়ে। সেখানে আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমর্থিত মুসলিম লীগের একটি ক্যাম্প অফিস ছিল। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সেখানে। অফিস সচিব শওকত আলী ক্যাম্পে আসা নেতাকর্মীদের দেখাশোনা করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানও তার কল্যাণে ক্যাম্প অফিসে থাকা-খাওয়া দুটোর নিশ্চয়তা পেলেন। এভাবেই পুরান ঢাকায় শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন। সেখানকার বেশ কয়েকটি বাড়িতে দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার রজনী বোস লেনের একটি বাসায় শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেস-জীবন। সেটা নিজের ভাড়া করা মেস নয়, মমিনুল হক খোকার মেস। মমিনুল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই। একদিন হঠাৎ করে তার মেসে উঠে যান বঙ্গবন্ধু। একটি চৌকিতেই থাকতে শুরু করেন মমিনুল আর বঙ্গবন্ধু। কাঁথা-বালিশ-চাদর সবকিছুই ফুফাতো ভাইয়ের কেনা।
৮/৩, নম্বর রজনী বোস লেনের এ ভবনের মেসে বঙ্গবন্ধুর অনেক রাজনৈতিক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মমিনুল হক খোকার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের দিকে শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহচর জালাল উদ্দিন মোল্লা এবং আবদুল হামিদ চৌধুরীকে নিয়ে আরমানিটোলার ৮/৩ নম্বর রজনী বোস লেনের মেসে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু ও তার রজনী বোস লেনের এই ছোট কক্ষটি এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বড় সাক্ষী। বঙ্গবন্ধুর ঢাকার রাজনৈতিক জীবনের অনেক ঐতিহাসিক উপাদান ওই কক্ষ ও তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মেস বাড়ির অদূরে আরমানিটোলার বটতলায় ছিল ‘অবনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। সেখানে শেখ মুজিব নিয়মিত আড্ডা দিতেন। সেই আড্ডায় মিলিত হতেন তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী হাফেজ মুসা, শওকত আলী, ইয়ার মোহাম্মদ খান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আতাউর রহমান খানসহ অনেকে। বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি চলত চা-নাস্তা খাওয়া। সেখানকার হালুয়া, লুচি, রসগোল্লা ও গরম ডালপুরি ছিল বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় খাবার।
অবনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছেই ছিল হাফেজ মুসার বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। পরবর্তী জীবনে তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। যখনই শুনতেন শেখ মুজিব অবনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এসেছেন, তিনি দৌড়ে এসে সেখানে হাজির হতেন। হাফেজ মুসা প্রয়াত মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফের আত্মীয় ছিলেন। ১৯৫৪ সালে বন্যার সময় বঙ্গবন্ধু স্ত্রী-সন্তানসহ তার বাড়িতে কিছু দিন বসবাস করেছিলেন।
আরমানিটোলায় হাফেজ মুসার বাড়িটি কিছু দিনের জন্যে ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের আশ্রয়স্থল। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জিতে মন্ত্রিত্ব লাভ করেছিলেন। এটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ‘ইউ টার্ন’।
মেসের ছোট একটি কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগপন্থি নেতা মোহাম্মদ খান লুন্দখোর অতিথি হিসেবে থেকেছিলেন বেশ কিছু দিন। মেসে থেকে তিনি অনুভব করেছিলেন—পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা কত কষ্টে জীবনযাপন করে মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমেদ এই মেসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করতেন।
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেগুনবাগিচায় সরকারি বাসভবনে ওঠেন। বেশি দিন থাকা হয়নি সে বাসায়। সরকার গঠনের ৫৬ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। আর তাঁর পরিবারকে সরকারি বাসভবন থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। তখন পরিবারটির মাথার ওপর ছাদ তো দূরের কথা, কোনও খড়কুটোও ছিল না। তারা অবশেষে আশ্রয় পান পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে মোহাম্মদ হানিফের বাসায়।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার তথা সন্তানদের পড়াশোনায়ও অনেক বিঘ্ন ঘটে। এমনকি বঙ্গবন্ধু তখন জেলে থাকায় অনেক বাড়িওয়ালা তাঁর পরিবারকে বাড়ি ভাড়াও দিতেন না, মূলত পুলিশি হয়রানির কারণে। সেগুনবাগিচায় বাসা ভাড়া নিতে গেলে একজন বিচারক (জজ) পর্যন্ত তাদের ফিরিয়ে দেন। তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম গ্যারান্টার হওয়ার পরও তারা বাসা ভাড়া পাননি।
গ্যারান্টার হয়ে জহুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের পরিবারকে বাসা ভাড়া দিলে কোনও অসুবিধা হবে না। তাদের সব দায়িত্ব আমার। তারা নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করবেন। না করলে তাদের ভাড়া আমি পরিশোধ করবো।’ পরে মুসলিম লীগের নেতা ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নে আজিজুল হক নান্না মিঞার অনুরোধে সেই জজ সাহেব সেগুনবাগিচার বাসা ভাড়া দিয়েছিলেন। নান্না মিঞা শেখ মুজিবের বিপরীতমুখী রাজনীতি করলেও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
পাকিস্তানের দোসররা বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেন। এমনকি তাদের কোনও স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি নেওয়া হতো না। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনেও। পাকিস্তানি শাসকদের ভয়ে যখন কোনও স্কুল তাকে ভর্তি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তখন এগিয়ে আসেন কবি সুফিয়া কামাল। তিনি থাকতেন পুরান ঢাকার টিকাটুলির একটি বাসায়। সেখানকার ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি শেখ হাসিনাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেন। বিপ্লবী নীলা নাগের প্রতিষ্ঠিত স্কুল নারী শিক্ষা মন্দির হয়ে শেখ হাসিনা কামরুননেসা গার্লস স্কুল, আজিমপুর গার্লস স্কুল হয়ে ইডেন কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন।
এভাবেই পুরান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও মেস-জীবনের ইতি ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে সেগুনবাগিচার বাসা ছেড়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দুটি বেড রুম, একটি ড্রইং রুম এবং একটি গেস্টরুমের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর পরিবার নতুন জীবন শুরু করেছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরেও তিনি গণভবন ও বঙ্গভবনের জৌলুস আর রাষ্ট্রীয় চাকচিক্যের সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে কার্পেটবিহীন, শীততাপ নিয়ন্ত্রণহীন এই বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন। কারণ, এ বাড়ির সঙ্গে বেগম মুজিব ও শেখ মুজিবের অনেক পরিশ্রম, ত্যাগ আর ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল।
লেখক: আতিক হাসান শুভ