পটুয়াখালী প্রতিনিধি : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর কয়েক মাস। চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিসহ সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্নভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে অনেকটা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অন্যদিকে গোপনে মাঠ গোছাচ্ছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তারা গোপনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
গত প্রায় এক যুগেরও বেশি সময়ে বর্তমান সরকারের নানাবিদ উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে দেশের অন্য জেলার চেয়ে পটুয়াখালী অনেকটা এগিয়ে আছে। যে কারণে পটুয়াখালীর চারটি আসনেই মাঠে বিচরণ করছেন শুধু আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এতদিন যারা কেন্দ্রে ছিলেন তারাও বারবার ছুটে আসছেন নিজ নিজ এলাকায়। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী তারাও বসে নেই। সামাজিক সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে নানাভাবে নিজেদের প্রার্থিতা প্রচার করছেন। তবে বিএনপির কোনো সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশী এখনো নির্বাচনী মাঠে প্রকাশ্যে নেই। দুটি আসনে জামায়াতে ইসলামী এবং গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
পটুয়াখালী-১ : পটুয়াখালী সদর, মির্জাগঞ্জ এবং দুমকী উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-১ আসনে মনোনয়নের জন্য মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, কেন্দ্রীয় শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য দানবীর মোহাম্মদ আলী আশরাফ, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি দৈনিক পটুয়াখালী পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট সুলতান আহমেদ মৃধা।
এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন ঢাকায় বসবাস করলেও প্রায়ই ছুটে আসেন পটুয়াখালীতে। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দলের নেতাদের কাছে তার রয়েছে আলাদা চাহিদা। এছাড়া বর্তমান সংসদ সদস্য সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান মিয়া, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সংরক্ষিত আসনের সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেন, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ খলিলুর রহমান মোহন মিয়া, দুমকী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ হাওলাদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম সরোয়ার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চান।
বয়সের ভারে শারীরিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায় মো. শাহজাহান মিয়ার বিকল্প এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার ছেলে সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট তারিকুজ্জামান মনিরের নামও শোনা যায়। তবে ত্যাগী নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই শাহজাহান মিয়া এবং খলিলুর রহমান মোহনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেন।
এই আসনে এককভাবে বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন সাবেক স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্যমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলহাজ আলতাফ হোসেন চৌধুরী। এছাড়া তালিকায় নাম আছে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ¯েœহাষু সরকার কুট্টি এবং জেলা বিএনপির সদস্য মোশতাক আহমেদ পিনুর। জাতীয় পার্টির
সাবেক মহাসচিব, পটুয়াখালী-১ আসনের সাবেক এমপি এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার আবারো এখান থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে বাকেরগঞ্জ থেকে এবার তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে গুঞ্জন রয়েছে।
পটুয়াখালী-২ : বাউফল উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-২ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং প্রকাশ্যে গ্রুপিং রয়েছে। গ্রুপিংয়ের কারণে রাজনৈতিক হত্যা, আহত, পঙ্গুত্ববরণের ঘটনাও ঘটেছে। এ কারণে এখানে দলটির সাতবারের এবং বর্তমান এমপি আ স ম ফিরোজের দলীয় মনোনয়ন অনিশ্চিত।
এই আসনে আ স ম ফিরোজের দলীয় প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে মনোনয়নপ্রত্যাশা করছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাউফল পৌরসভার মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার, বীর উত্তম মরহুম শামসুর আলম তালুকদারের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শিল্পপতি হাসীব আলম তালুকদার, শিল্পপতি এস এম ফিরোজ আলম এবং কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খন্দকার সামসুর হক রেজা।
প্রকাশে মাঠে না থাকলেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে কৌশলে মাঠে রয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ মুনির হোসেন, সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার, শহীদ জিয়া গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আনিচুর রহমান আনিচ।
তবে এই আসন থেকে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা দক্ষিণ শাখা সাধারণ সম্পাদক ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের প্রার্থিতা প্রায় চূড়ান্ত বলে জানা গেছে।
পটুয়াখালী-৩ : গলাচিপা আর দশমিনা উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-৩ আসনটি বিভিন্ন কারণে বেশ আলোচিত। সাবেক এমপি, বিতর্কিত আলোচক গোলাম মাওলা রনি এবং গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ঢাবির সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের গ্রামের বাড়ি এই আসনে হওয়ায় এমনিতেই সারা বছর কমবেশি আলোচনায় থাকে। মূলত, আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এবারের নির্বাচনে বিএনপি থেকে যদি সাবেক ছাত্রনেতা হাসান মামুনকে প্রার্থী দেয়া হয় তাহলে তার জয়ের ব্যাপারে সবাই আশাবাদী।
কারণ দলবল নির্বিশেষে এলাকাবাসীর জন্য অনেক কাজ করেছেন এবং বেকার যুবকদের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তারপরেও আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে আসনটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
এছাড়া বর্তমান এমপি জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য এস এম শাহজাদা, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলমগীর, সাবেক বিজিবিপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) আবুল হোসেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক কামরান সাহিদ প্রিন্স মহব্বত, সাবেক এমপি মন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনের ছেলে আ স ম জাওয়াদ সুজন দলীয় মনোনয়ন লাভের চেষ্টা করছেন।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এই আসনে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক ছাত্রনেতা মো. হাসান মামুনের মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি, গলাচিপা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা, জেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. শিপলু খানের নামও আলোচনা রয়েছে। তবে এখান থেকে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
পটুয়াখালী-৪ : কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে আওয়ামী লীগে রয়েছে গ্রুপিং আর দ্ব›দ্ব। যার খেসারত দিচ্ছে তৃণমূল। আওয়ামী লীগের গ্রুপিংয়ের কারণেই এখানে ইসলামী আন্দোলন শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই আসন থেকে হাত পাখার প্রার্থীরা তিনটি স্থানে জয়ী হয়েছে। অথচ বর্তমান এমপি এবং সাবেক এমপির ভোটব্যাংকের শক্ত অবস্থান ছিল এ আসনে। তাদের প্রকাশ্য ও নীরবের গ্রুপিংয়ের খেসারত আগামী জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এতকিছুর পরেও এই আসনে বর্তমান এমপি মহিবুর রহমান মহিব, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার, এনএসআইর সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাবিবুর রহমান মিলন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাকিবুল আহসান, ওয়াশিংটন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মো. আলাউদ্দিন আহমেদ, সাবেক এমপি মরহুম আনোয়ার হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ আল ইসলাম লিটন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শামিম আল সাইফুর সোহাগ নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন।
বিএনপি থেকে এই আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক ও কলাপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এ বি এম মোশাররফ হোসেন এবং কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান মনির।
পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতান আহমেদ মৃধা বলেন, মনোনয়নের জন্য প্রচার-প্রচারণা অনেকেই করবেন। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাছাই-বাছাই করে যোগ্য ব্যক্তিকে পটুয়াখালীতে মনোনয়ন দেবেন। পটুয়াখালীর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নৌকায় ভোট দিতে সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকে আবারো ক্ষমতায় আনবেন।
পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। এবার আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে গোল দিতে দেব না। সেই লক্ষ্যে পটুয়াখালীর চার?টি সংসদীয় আস?নে আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে আমরা অনেক বেশি শক্তিশালী। নির্বাচন করার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে।