এইচ.এম.এ রাতুল : পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, যথাযথ পুনর্বাসন, বিকল্প কর্মসংস্থান ও কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা নিরসন-প্রতিকারের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুওে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জননী সাহান আরা বেগম স্মৃতি মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরাম।
অধ্যাপক এস এম জাহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের সমন্বয়কারী শুভংকর চক্রবর্তী । এসময় উপস্থিত ছিলেন বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের সুভাস চন্দ্র নিতাই ও উন্নয়ন সংগঠক এস এম শাহাজাদা, সাংবাদিক সুশান্ত ঘোষ, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মিথুন সাহা প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের সমন্বয়কারী শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তন্মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মাত্রা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ-আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। এ সময়ে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিধস নদীভাঙ্গন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্র উপকূলে লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে দেশের বাস্তুচ্যুত পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়েছে ১৫ লাখ ২৪ হাজার জন। বাংলাদেশ একটি আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার দেশ।
তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। এইসব উন্নয়নের ফলে যেমন দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয়, তার সাথে সাথে কিছু পরিবারের বসতি ও কর্মসংস্থানের পরিবর্তন ঘটে এবং পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এইসব উন্নয়নমূলক কার্যক্রমসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জমির শ্রেণি পরিবর্তনের ফলে, কিছু পরিবার স্বেচ্ছায় তাদের চলমান জীবন-জীবিকার ত্যাগ স্বীকার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের জীবন-জীবিকা, সামাজিক ও মনস্তাত্বিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তিনি বলেন, ভূমিহীনতা ও ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা বহির্ভূত ব্যবহারের ফলে কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে আবার দেশের খাদ্য নিরাপত্তার উপরও বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। সরকারের খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুসারে বিভিন্ন জেলায় উদ্বাস্তু ও ভূমিহীনদের যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। টেকসই ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য এটা ইতিবাচক লক্ষণ নয়। বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত কলাপাড়া উপজেলা। সাগর তীরবর্তী দক্ষিণের জনপদ পর্যটন সমৃদ্ধ কলাপাড়া উপজেলায় অবস্থিত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী ভাঙন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্র উপকূলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ফলে কলাপাড়া উপজেলায় বাস্তুচ্যুত পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় সরকার বাস্তবায়ন করছে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি এবং হাজার হাজার পরিবারের বসতবাড়ি। বিগত দশ বছরে চলমান এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য এবং ক্ষতিপূরণ অনিশ্চয়তা ছাড়াও আছে দালাল ও কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার উৎপাত। সম্প্রতি ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো কর্তৃক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার দাবিতে বালিয়াতলী ইউপি’র চর বালিয়াতলী মৌজার বাসিন্দারা মানববন্ধন করেন। দালালের সহায়তায় প্রকৃত জমির মালিকের বিরুদ্ধে ঠুকে দেওয়া হয় মামলা। অনেক জমির মালিকের ক্ষতিপূরণের টাকা আটকে গেছে এমন ভুয়া মামলায়। এতে মিলছে না ক্ষতিপূরণ, ঠাঁই হচ্ছে না পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে বহু পরিবারকে। আবার অনেককে পুনর্বাসন করা হলেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কৃষক ও জেলে পরিবার হঠাৎ হারিয়েছে মাছ ধরার জলাশয় এবং কৃষিজমি। তাঁরা এখন বেকার। কলাপাড়ায় মেগা প্রকল্পের কারণে ইলিশ প্রজননসহ প্রাণ-প্রকৃতিরও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রাখাইনদের ২৩৯ বছরের পুরোনো ছয়ানীপাড়া পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
এসময় তিনি বলেন, বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের পক্ষে থেকে আমরা দাবি জানাচ্ছি, কলাপাড়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, যথাযথ পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। সেই সাথে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করে না এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হোক। সর্বোপরি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমীক্ষা পরিচালনা করে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।