ডেস্ক রিপোর্ট: বগুড়াতে এরকম ভালো মানের স্ট্রিট ফুডের দোকান নেই। যেখানে হাইজিন মেইনটেন করা হয়। এখানকার পরিবেশ খুব ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমরা ৫০ টাকা দিয়ে যে বার্গার খাচ্ছি এটা ২০০ টাকার বার্গারের চেয়ে বেটার। আর বার্গারের টেস্টটাও ছিলো অনেক ভালো। এটাকে দশে দশ রেটিং দেবো। কারণ রুটি, চিকেনসহ বার্গারের ভেতর যেসব খাবার ব্যবহার করা হয়েছে সব মিলিয়ে আমার কাছে পারফেক্ট মনে হয়েছে। কথাগুলো বলছিলেন ‘ঢাকা সাব এন্ড শর্মা’ নামের স্ট্রিট ফুডের দোকানে খেতে আসা রবিন নামের একজন কাস্টমার।
শহরের আদালত পাড়ার রোমেনা আফাজ সড়কের এই স্ট্রিট ফুডের দোকানটি পরিচালনা করছেন চারজন তরুণ উদ্যোক্তা। যারা প্রত্যেকেই শিক্ষার্থী। এদের কেউ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে, আবার কেউ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়াশোনা করছেন। স্বপ্নবাজ এই যুবকরা স্বপ্ন দেখেন এই স্ট্রিডফুডের দোকান থেকেই তাদের ভবিষ্যতকে ঝকঝকে আলোয় আলোকিত করার। যে কারণে রাস্তায় খাবার বিক্রিকে অনেকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখলেও ওই দৃষ্টিকে এসব যুবক ও তাদের পরিবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ‘ঢাকা সাব এন্ড শর্মা’ দোকানে মৌমাছির মতো কাস্টমার লেগেই আছে। কোনো সময় এই ফাস্ট ফুড দোকানের বসার বেঞ্চ খালি থাকে না। ব্যবসার শুরুর দিন থেকেই ব্যবসা এমন জমজমাট বলে জানিয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। ‘ঢাকা সাব এন্ড শর্মা’ প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ পিছ বার্গার বিক্রি হয় বলেও দাবি তাদের।
খাবারের প্রশংসা করে রিফাত নামের এক কাস্টমার বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো স্টুডেন্ট (ছাত্র) যদি কিছু একটা করে তবে সেটা তার জন্যও ভালো এবং তার পরিবারের জন্যও ভালো। আমি নিয়মিত এই দোকানে আসি। এদের বার্গার খুব ভালো লাগে। ঢাকা সাব এন্ড শর্মার উদ্যোক্তাদের দেখে তিনি নিজেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন জানিয়ে বলেন, আমি নিজেও কিছু করতে চাই। পড়াশোনা শেষ। বর্তমানে চাকরির যে অবস্থা। তাতে করে আমিও এরকম স্ট্রিট ফুড নিয়ে পরিকল্পনা করছি।
স্ট্রিট ফুড নিয়ে ব্যবসার প্রথম চিন্তা আসে শামিম হোসেন নামের একজন উদ্যোক্তার। বর্তমানে তিনি অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। চলতি বছরের মে মাসে তিনি তার ছোট দুই ভাই এবং ভাইয়ের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসাটি শুরু করেন।
উদ্যোক্তা শামিম হোসেন বলেন, ঢাকাতে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা থাকাকালীন তিনি খাবারের ওপর ৩ মাসের কোর্স করেন। ২০১৭ সালে তিনি বগুড়ায় ফিরে আসেন। এর মধ্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি ফুড এন্ড কনজ্যুমার প্রোডাক্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন কয়েক বছর। তবে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কি করবেন সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। ফুডের উপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সে সময় তিনি পরিকল্পনা করেন স্ট্রিট ফুডের ব্যবসা শুরু করবেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে স্ট্রিট ফুডের জন্য গাড়ি তৈরি করেন। পরে চলতি বছরের ১ মে থেকে তিনি তার ছোট দুইভাই এবং তার ভাইয়ের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শহরের রোমেনা আফাজ সড়কের জজ আদালতের সামনে দোকান খুলে বসেন। প্রথম দিন থেকেই তার ব্যবসার চাকা ঘুরতে শুরু করে।
তিনি আরও বলেন, বার্গার বা শর্মার জন্য যে চিকেনের প্রয়োজন হয় সেটি তার বাবা এবং মা রান্না করে দেন। তিনি তাদের চিকেন রান্না শিখিয়ে দিয়েছেন।
শামিম বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমার ইচ্ছে ছিলো আমি সবাইকে খাওয়াবো যে কারণে ৫০ টাকার বার্গার চুজ করেছি। এতে প্রফিট কম হয়। তবে বিক্রি বেশি হয় এ জন্য পুষিয়ে যায়। প্রতিদিন গড়ে ৪০০-৫০০ পিস বার্গার বিক্রি হয় আমার এই দোকানে।’
উদ্যোক্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা চারজন মিলে এটা পরিচালনা করছি। এদের মধ্যে শামিম হোসেন আমার বড় ভাই, আহাদ নামের আরেকজন আছে তিনিও আমার বড় ভাই হন। আরেকজন আমার বন্ধু রয়েছে। আমরা প্রতিদিনই দোকান খুলে ব্যবসা পরিচালনা করি। আমাদের এখানে বার্গার, চকলেট বার্গার, সাব স্যান্ডউইচ, শর্মা পাওয়া যায়। বার্গার ৫০ টাকা, সাব স্যান্ডউইচ ৭০ টাকা এবং শর্মা ৮০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে।’
অপর উদ্যোক্তা আবু আহাদ বলেন, ‘আমাদের স্পেশালিটি হলো আমরা মেইনলি যেটা দিচ্ছি সেটা হলো সাব এন্ড শর্মা। কারণ বগুড়াতে স্ট্রিটে সাব এন্ড শর্মা নেই বললেই চলে। আমাদের বার্গারে চিকেন, মেওনিজ, সস, ক্যাভেজ মূলত যেগুলো থাকে আমরা সেগুলোই দিচ্ছি। কস্টিং হিসেব করে যতটুকু দেয়া দরকার ততটুকু দিচ্ছি। যাতে আমাদেরও কিছু প্রফিট আসে এবং কাস্টমারদেরও মন রক্ষা করতে পারি সেরকম ভাবেই আমরা একটা প্রাইস বসিয়ে দিয়েছি। আমাদের খাবারে কাস্টমার ভালো রিভিউ দিচ্ছে। আমাদের যেটা চাওয়া ছিলো সেটা তাদের থেকে পাচ্ছি। এ কারণে আমরা আরো বেশি অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমাদের পরিবার থেকে ফুল সাপোর্ট আছে। উনারা যদি আমাদের সাপোর্ট না করতেন তাহলে আমরা পারতাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ৪ জন মিলে এটা পরিচালনা করছি। আমাদের যেটা উপার্জন হয় মাসে আমরা সেখান থেকে চারজন নির্ধারিত স্যালারি নিয়ে বাকি টাকা সেভিংস করছি সবার জন্যই। স্যালারি করেছি এজন্য যে যদি যার যখন যেটা প্রয়োজন পড়ে যদি নিয়ে নেই তাহলে দেখা যাবে মাস শেষে আমাদের কিছুই থাকবে না।’
ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার আগেই এভাবে স্ট্রিট ফুডের বিজনেস শুরু করলেন কেন জানতে চাইলে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের ফ্যামিলিতেও কিছু দায়িত্ব থাকে। আমরা এতটাও ছোট না যে আমাদের ফ্যামিলির কিছু দায়ভার আমাদের থাকবে না। আমি মনে করি এই বয়স থেকেই ফ্যামিলির দায়ভার নিলে ভবিষ্যতে সেটা আমাদের কাছে বড় কিছু মনে হবে না।’
ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যত পরিকল্পনা তো কিছু একটা আমাদের আছে। কিন্তু সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর চলবে না। তাই শুরু করছি কিছু একটা।’
উদ্যোক্তাদের বন্ধু জাকারিয়া বলেন, ‘শামিম আমার ছোট বেলার বন্ধু। বাকি দু’জন আমার সাবেক সহকর্মী। চাকরি ছেড়ে তারা পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেস করছে। এই বয়সে দেখা যায় অনেক ছেলে মাদক আশক্ত হয়ে বিপথে চলে যায়। সেখানে তারা নিজেরা স্টাবলিশ হচ্ছে। এখান থেকে তারা ভালো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে পারবে। কিন্তু অনেকে আছে যারা উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে বা অনেকে কিছু পরিকল্পনা করেও বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এক সময় হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন তারা। এখানে আমার বন্ধুরা আলাদা। তারা সাহস করে এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে এমনটাই হওয়া উচিত।’