নিজস্ব প্রতিবেদক : রাতারাতি ধনী হওয়ার ফাঁদে পা দিয়ে এমটিএফই নামে একটি বিদেশি অ্যাপে বিনিয়োগ করে বরিশালের শত শত মানুষ এখন হাহাকার করছেন। প্রতারিত হওয়ার পর তারা না পাচ্ছেন তথাকথিত টিম লিডারদের দেখা, না পারছেন এ ব্যাপারে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে। ঠিক কত মানুষ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই কারও কাছে। তবে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই যুবক। গোটা জেলাতেই বিছানো ছিল এই চক্রের জাল। আর বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌফিকুর রহমান সিকদার এমটিএফই এর সিইও থাকায় ওই এলাকার বেশিরভাগ মানুষই প্রতারিত হয়েছেন। যারা তাদের নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। তবে একাধিক ভুক্তভোগী মেসেজ ও মুঠোফোনে তাদের প্রতারণার কথা জানিয়েছেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, তারা এমন বিষয় শুনেছেন। কিন্তু কেউ তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ-এমটিএফই হচ্ছে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বিনিয়োগকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। বিনিয়োগকারী যার মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন তিনিও এর কমিশন পাবেন। কারও অধীনে ১০০ বিনিয়োগকারী থাকলে তিনি ‘সিইও’ হিসেবে গণ্য হবেন। হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌফিকুর রহমান সিকদার ওই প্রতিষ্ঠানটির একজন সিইও।
একাধিক বিনিয়োগকারী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, চেয়ারম্যান তৌফিক বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে শুরুতে গ্রাহকদের তিন হাজার টাকায় এমটিএফই প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিত। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ‘রেফার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে টিম লিডারের হিসাব বা আইডি নম্বর। পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীরা এই অ্যাপে ডলার জমা করতেন। তাদেরকে বলা হতো, এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে লাভ পাওয়া যাবে। এই ফাঁদে পড়েই অনেকে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সম্প্রতি বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলতে পারছিলেন না, তখন বলা হয় সফটওয়্যার আপডেটের কথা। হঠাৎ করেই বিনিয়োগকারীদের অ্যাপের অ্যাকাউন্টে জমা থাকা ডলারের বিপরীতে সমপরিমাণ দেনা দেখাতে থাকে। তারা নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারছিলেন না। পরে অ্যাপটি উধাও হয়ে যায়।
এদিকে সিইও তৌফিক বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে এমটিএফই নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করতেন। যখনই বিনিয়োগকারীরা অ্যাপটিতে ঢুকতে পারছিলেন না এবং নানাবিধ সমস্যা দেখেন তখন ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এ বিষয়ে প্রায় প্রত্যেকেই সমস্যার বিষয়ে জানতে চান। এ ধরণের কথোপকথোনের একটি তথ্য ভোরের কাগজের এ প্রতিনিধির কাছে এসেছে। যাতে দেখা যায়, চেয়ারম্যান তৌফিক বিনিয়োগকারীদের শান্ত থাকার আহবান জানিয়ে বলছেন, “আসসালামু আলাইকুম। সকলকে ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ করছি। শেষ মুহুর্তের আপডেট চলছে। আপডেট এর কারণে ট্রেড বন্ধ রাখতে পারেন, সুতরাং আমরা সকলেই ধৈর্য্য ধারণ করি”। “সিইও যারা দুবাই অবস্থান করছেন, দয়া করে আপনারা সকলে বসে আমাদের একটা উপদেশ দিন। কোম্পানী দীর্ঘদিন ঐঝও এর ট্রেডিং করতো, অবশ্যই ঐঝও এর সাথে এমটিএফই এর ম্যানেজমেন্ট এর সাথে যোগাযোগ আছে”।
এদিকে শেষ পর্যন্ত এমটিএফই প্রতারণা করলে বিনিয়োগকারীরা ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকলে তাদেরকে গ্রুপ থেকে রিমুভ করে দেয়া হয়।
হাসান নামে একজন জানান, এই অ্যাপ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তাকেসহ কয়েকজনকে এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন হিজলার হরিনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান তৌফিকুর রহমান সিকদার। তার কথা শুনেই তাদের একটি সেমিনারে অংশ নেন। সেখানে বলা হয়, লাখ টাকায় প্রতিদিন ২ হাজার টাকা লাভ আসবে, লোকসানের আশঙ্কা নেই। সেখান থেকেই বিনিয়োগে উদ্বুব্ধ হন তিনি। তার মতো বরিশালের কয়েকশ’ লোক বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হয়েছেন। এখন সিইও চেয়ারম্যান তৌফিক কারো সাথে যোগাযোগ করেন না।
এ বিষয়ে কথা বলতে অ্যাপটির সিইও হরিনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান তৌফিকুর রহমান সিকদার এর ব্যবহৃত ৩টি ফোন নাম্বারে (নাম্বার ০১৭৪৫ … ০৫৯, ০১৭১৩ …. ১৬৫, ০১৭৫৩ … ১৫৫৫) এবং তার স্ত্রী ও ভাই তাওহীদ এর মুঠোফোনেও ফোন দিয়ে সবগুলো নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি পরিবারের লোকজন সহ এলাকায় থাকলেও আত্মগোপনে রয়েছেন। কারো সাথে যোগাযোগ করেন না।
হিজলা থানার ওসি জুবাইর বলেন, “এ রকম কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
বরিশাল পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজওয়ান আহমেদ বলেন, ইতোমধ্যে এমটিএফই এর প্রতারণার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। পুলিশের বিশেষ শাখা এ বিষয়ে কাজ করছে এবং তৎপর রয়েছে।