ডেস্ক রিপোর্ট : ‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে’ পালকির বেহারাদের এই ছন্দতোলা গানগুলো এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না গ্রাম বাংলার মেঠো পথে।
হাজার বছরের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য পালকিকে এখন আর মেঠো পথে চলতেও দেখা যায় না। কালের বিবর্তনে পালকি এখন জাদুঘরে ও বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে। নতুন প্রজন্মের সাথে পালকির পরিচয় নেই বললেই চলে।
তারা পালকির কথা বইয়ের পাতায় এবং লোক ও কারু জাদুঘরে গিয়ে দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু পূর্বের দিনে বিয়ের বরযাত্রায় পালকির ছিল একটি ভিন্ন জৌলুস। বর পালকি চড়ে কনের বাড়ি যেত, আবার কনেও পালকি চড়ে শ্বশুরবাড়িতে আসতো।
পালকি শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘পালঙ্ক’ থেকে। যার অর্থ শয্যা বা বিছানা। পালকি মানুষ চালিত চাকাবিহীন একটি বাহন। উপমহাদেশে পালকির প্রচলন কখন হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তবে পালকির উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ‘বাল্মীকির রামায়ণে’ পালকির কথা উল্লেখ রয়েছে।
তাই ধারনা করা হয়, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পালকির প্রচলন শুরু হয়েছিল। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয় এর বাইরেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পালকির প্রচলন ছিল।
প্রাচীন রোমে পালকিকে বলা হতো লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো ও তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত ছিল। এমনকি ব্রিটেনের রাজা ও লেখক অষ্টম হেনরি আমৃত্যু পালকিতে চড়েছেন বলে জানা গেছে।
সাধারণত একটি বা দুটি লম্বা বাঁশ বা কাঠের দন্ডে বড় চেয়ার বা খাট ঝুলিয়ে এবং কাঠ, বাঁশ বা কাপড় দিয়ে আবৃত করে পালকি তৈরি করা হতো। পালকি দেখতে অনেকটা কাঠের বাক্সের মত। প্রতিটি পালকির দৈর্ঘ্য ৬ ফুট ও প্রস্থ তার অর্ধেক। কাঠামো লম্বা ও দু’পাশে বাঁশের সাহায্যে গাঁথা। পালকির উপরে দামি কাপড় দ্বারা মোড়ানো হয়। পালকি বহনকারীদের ডাকা হতো ‘কাহার’ বা ‘বেহারা’ নামে। প্রতিটি পালকি চালাতে চারজন বেহারা বা কাহার প্রয়োজন হতো।
একসময়, পালকি আমাদের দেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী ও গরিব সবার কাছে সমান পছন্দনীয় বাহন ছিলো। তখন আবার সব পরিবারে পালকি ছিলো না। বিত্তশালী, জমিদার ও উচ্চ বংশীয় লোকদের প্রত্যেকের বাড়িতে পালকি ছিল। সেসময় পালকি বংশের মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার হত।
নিন্মবিত্ত পরিবারের লোকদের বাড়িতে পালকি ছিল না। তাই তাদের জন্য ছিলো অন্য ব্যবস্থা। তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে পালকি ভাড়া করত অর্থ বা কড়ির বিনিময়ে। কিন্তু বিয়ে বা যে কোন উৎসবে পালকি থাকতেই হতো।
পালকি আমাদের দেশের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। পালকি নিয়ে লেখা হয়েছে গান, ছড়াসহ হাজারও কবিতা। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ অনেক কবি পালকি নিয়ে লিখেছেন। পালকি চলার সময় বেহারারা ‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে’ এসব পালকি বহনের গান গাইত। এছাড়াও ‘পালকি চলে, পালকি চলে, গগনতলে আগুন জ্বলে’… আরো সুন্দর ছন্দবদ্ধ কথা ‘… তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে …।’
সেসময় পালকির কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার এদেশে আসা ভ্রমণ কাহিনী ‘রোহেলা’ তে। তার লেখার মধ্যে এ কথাও পাওয়া যায় যে, তিনি পালকি বহনের দৃশ্যে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
এছাড়াও সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের বরণ করতে সেসময় পালকির বিকল্প যেন পালকিই ছিলো। আমাদের দেশে এমন এক সময় গেছে, যখন বিয়ের অনুষ্ঠান পালকি ছাড়া হতোই না, পালকি ছাড়া বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে যেন নিজেদের হতভাগা বলে মনে হতো। পালকিকে ঘিরে অনেক লোক তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো।
পালকি এখন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য। সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন, নতুন প্রজন্ম লোকশিল্প যাদুঘরে গিয়ে সাজানো গোছানো কৃত্রিম পালকি দেখবে। পালকির সেই ঐতিহ্যময় হাজার বছরের ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি বিভিন্ন রংয়ের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন অনেকটাই স্বপ্ন। সেই সাথে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গানও।
লেখক: খন্দকার মাজেদুল ইসলাম সম্রাট, আইনজীবী ও সংবাদকর্মী