ডেস্ক রিপোর্ট: বন্ধু চল, হাত ধরে! বন্ধুরা এলোমেলো হলেও প্রত্যেক মুহূর্তের যাপনে বারবার উঠে আসে আমাদের জীবনে বন্ধুর গুরুত্ব। কখনও যেন বন্ধুরাই বলে যায় বাঁচার কথা। তাদের সঙ্গযাপনেই গড়ে ওঠে ভাল থাকার অট্টালিকাও। কিন্তু এত বন্ধুর পাহাড়েও অকালেই হারিয়ে যান কেউ কেউ! নিরন্তর মনখারাপের বাঁশিতে কেন ওঠে বেদনার সুর! চিকিৎসা, কাউন্সেলিংয়ের পরেও উঠে আসে মনের অসুখ নিয়ে নানাবিধ অবহেলার কথাও। শরীরের অসুখের সঙ্গেই গড়ে ওঠে মন-অসুখের ভয়াবহতাও।
কিন্তু সঙ্গী, সঠিক বন্ধুত্ব ঠিক কীভাবে কমিয়ে দিতে পারে অবসাদ? কেন মনের অসুখের নিবারণে প্রয়োজন একজন সঠিক বন্ধুর হাত! বন্ধুর কাছেই রয়েছে মনভালর ওষুধ? বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসের আবহে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিল ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’। ঠিক কী উঠে এল আমাদের তথ্যানুসন্ধানে?
সত্যিই কি এক বন্ধুই অবসাদ সারাতে হাজার ওষুধের সমান? বহু বছর ধরে মনের রোগ সারাচ্ছেন চিকিৎসক মুক্তানন্দ কুণ্ডু। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কথায়, ”বন্ধু আপনার জীবনের ভাল ও খারাপ, দুই ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক, আপনার মনখারাপ হল। সেক্ষেত্রে যেমন একজন বন্ধু ভীষণ কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারে, আবার আপনার ভাল থাকা মনকে খারাপ করতেও গুরুত্ব রয়েছে এই সম্পর্কের। তাই সমস্ত চিকিৎসার পাশেই এই সম্পর্কের দাম আছেই। জীবনের সব ভাল ও মন্দে বন্ধু অবশ্যই প্রয়োজন।”
প্রায় একই সুর মনোরোগের অধ্যাপক-চিকিৎসক অনির্বাণ রায়ের। তিনি বলছেন, ”বন্ধু মানে এমন একটা সম্পর্ক যেখানে আমাদের কমফোর্ট জোন রয়েছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমাজ, বিশেষত পরিবারের একটা প্রভাব থাকেই। কিন্তু ছোটবেলায় পরিবার আবার বড় হতে হতে সেই পরিবারের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। আমি ঠিক কার কাছে বেশি স্বচ্ছন্দ! আমার মতো কে, এই বিষয়টি গুরুত্ব পায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বন্ধুও এমন একটা স্থান। যা আমার ভালথাকার উপজীব্য হয়ে ওঠে নিরন্তর। যেখানেই আমরা খুঁজে পাই মনখারাপের ওষুধ। যা পুরোপুরি মন ভাল করতে না পারলেও চিকিৎসার সঙ্গে খানিকটা সাহায্য তো করেই।”
যদিও এক্ষেত্রে খানিকটা ভিন্নসুর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদারের। তিনি বলছেন, ”আসলে কথা বললে অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশ করলে মনখারাপ, অবসাদের মাত্রা কমতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। কিন্তু অবসাদ আসলেই একটি অসুখ। একে সারানোর জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এখানে বন্ধু নয়, যেকোনও কমফোর্ট জোনে কথা বললে একটু উপকার হতে পারে শুধু। তবে আদতে বন্ধু দিয়েই মনভাল হবে, এরকম কিছুই হয় না!”
আসলে এজগতে একাকীত্ব বড় সমস্যা। ব্যস্ততম জীবনযাপনে সঙ্গযাপন সত্যিই কঠিন। আসল বন্ধু পাওয়াও চাপের। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই বন্ধু এবং অবসাদ নিয়ে ব্যাখা দিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অভিরুচি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ”মনে রাখতে হবে ডিপ্রেসন অর্থাৎ মানসিক অবসাদ কিন্তু একটা অসুখ। এর চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু এটাও ঠিক, এই সময় আমরা বেশ একা। বন্ধু বা মনের কথা বলার লোকের বড্ড অভাব। এখানে দাঁড়িয়ে যেকোনও অসুখের ক্ষেত্রেই আমরা যদি মনের কথা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারি, তাহলে তো খানিকটা উপশম হয়-ই! বন্ধুও ঠিক তাই।”
মনের অসুখে বন্ধুত্বের হাত নিয়ে ব্যাখা দিয়েছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শ্রীতমা চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলছেন, ”আমাদের অর্থাৎ মানুষের জীবনযাপনে কিছু সহজাত প্রয়োজন রয়েছে। বন্ধুত্বও সেই প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করতে পারে। এটি আমাদের আনন্দময় সময়গুলির উদযাপনেও সাহায্য করতে পারে। বন্ধুদের সঙ্গেই আমাদের দুর্বল অভিজ্ঞতাগুলি ভাগ করে নেওয়া যায়। ভাল বন্ধু আমাদের বিচার না করে, উৎসাহিত করতে পারে। যা নেতিবাচক মনোভাব কমাতে কার্যকরি। এই ক্ষেত্রেই কমতে পারে মনখারাপ।” অবসাদের সমস্ত চিকিৎসার সঙ্গেই, বন্ধুত্বও একটি উপাদান হতে পারে বলেই মত চিকিৎসক শ্রীতমার।
সারাবছর মন নিয়েই কাজ করেন মনোবিদ শ্রাবন্তী মিত্র। তাঁর কথায়, ”বন্ধুত্বকে আমরা নির্দিষ্ট পরিসরে বেধে ফেলতে পারি না। বন্ধুত্ব শর্তহীন। বন্ধুত্বের কাছে সাধারণত নিজের অসম্মানের ভয় নেই, তাই বন্ধুত্ব আমাদের কাছে স্বস্তির জায়গা, শান্তির জায়গা। যার মধ্যে চেনা সম্পর্কের পরিসর থেকে বের করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় নতুন করে।” এই কারণেই মনখারাপ হলে বন্ধুই বেশি প্রয়োজন বলেই মত শ্রাবন্তীর।
বন্ধু বিনা মন চলে না! বন্ধু ছাড়া ভাল লাগে না কিছুই! কখনও প্রেম-পরিণয় ছাড়িয়েও বন্ধুই হয়ে ওঠে গুরুত্বের। মনের অবসাদ শেষে ওষুধের সঙ্গেই খানিকটা উপকারী হতে পারে এই বন্ধুত্বের সম্পর্কই, বলছেন মনের কারবারিদের একাংশও।