ডেস্ক রিপোর্ট : ১৭ মে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার দিন। ১৯৮১ সালের এই দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং বিমানে দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা ফিরেছিলেন। তিনি বাধ্য হয়েই নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। দুঃসহ শোক ও বেদনাকে সঙ্গী করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের লাল চোখ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে এসেছিলেন এই অঙ্গীকার নিয়ে যে, ‘দেশে ফিরে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করাই হবে তার প্রথম দায়িত্ব।’ ৪১ বছর ধরে এই দায়িত্ব তিনি অবিচলভাবে পালন করছেন। পিতা যে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, সেই দেশটিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কন্যা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বাংলাদেশের চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত দীর্ঘ সময় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বও আগে এত বেশি সময় কেউ পালন করার সুযোগ পাননি।
ইতিহাস শেখ হাসিনার ওপর যে দায় ও দায়িত্ব অর্পণ করেছে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করছেন ক্লান্তিহীনভাবেই। ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের ঐক্য ধরে রাখার বৃহত্তর প্রয়োজনে ‘বাধ্যতামূলক নির্বাসনে’ থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকণ্ডের দিন শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৫ আগস্ট তারা দেশে থাকলে তাদেরও পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো পরিণতি বরণ করতে হতো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। ঘাতকচক্র এবং তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মদদদাতা ও পৃষ্ঠপোষকরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে উল্টো ধারায় নিতে চেয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে সফলও হয়েছে। যে পাকিস্তানি ধারাকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, সেই পরাজিত ধারায় দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল ঘাতক এবং তাদের মুরুব্বিদের লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় বছর পর শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা ছিল ওই খুনিচক্রের বিরুদ্ধ প্রথম কার্যকর প্রতিবাদ। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বজ্রমুঠি শিথিল হওয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতার শুরু।
শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করে তখন আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। বিমান থেকে মাটিতে নেমে শেখ হাসিনা কান্না থামাতে পারেননি। আবেগতাড়িত হওয়াই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক। একদিকে আকাশের কান্না, আর একদিকে শেখ হাসিনার কান্না-দুইয়ে মিলে গ্লানি মোচনের এক বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল ১৯৮১ সালের ১৭ মে রোববারের সেই বিকেলে।
শেখ মুজিব যে রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্র তার জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। মুজিবের হাতে গড়া দল, আওয়ামী লীগ, যে দল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সে দলটিও মুজিব-হত্যার আকস্মিকতায় ছিল হতবিহ্বল। তারাও কোনো কার্যকর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত ব্যর্থতা খুনিদের উল্লাস নৃত্য দেখতে বাধ্য করেছিল গোটা জাতিকে।
নেতার লাশ যখন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়েছিল, তখন তারই অনুসারীরা চরম কাপুরুষতা দেখিয়ে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছে। তারপর নানা ঘটনাধারায় সময় গড়িয়েছে। উত্থানপতন চলেছে ক্ষমতা দখলকারীদের মধ্যেও। জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে মূলত নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল। হতোদ্যম, হতোবল আওয়ামী লীগ আবার সংগঠিত হোক, শক্তি অর্জন করুক, সেটাও চায়নি ক্ষমতাদখলকারীরা।
দেশের রাজনীতি যখন চরম এক অনিশ্চয়তার মুখে, জাতির পতাকা যখন খামচে ধরেছে পুরনো শকুন– ঠিক সেই সময় আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন শেখ হাসিনা। যার রক্তে বহমান শেখ মুজিবের রক্ত। তিনি দলের নেতৃত্ব নেওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্য যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস তৈরি হয়, তা আরও বেগবান হয় এক বৈরি পরিবেশে দেশে ফিরে আসায়।
শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরে আসতে না পারেন, তিনি যাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিতে না পারেন, তার জন্য নানা ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। শেখ হাসিনার সাহস ও দৃঢতার কাছে পরাভূত হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভীষণ ছিল, ছিল মোশতাকের প্রেতাত্মা। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এবং তৃণমূল পর্যায়ের মুজিবভক্তদের জীবনপণ ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞার কাছে।
১৯৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ১৭ মে শেখ হাসিনাকে বরণ করার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল। যারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হারিয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারেননি, তারা ১৭ মে অকাতরে চোখের জল ঢেলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন যেন। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তাৎক্ষণিকভাবেই তৈরি হয়েছিল পরিবর্তনের অভিঘাত। মুক্তিযুদ্ধের হারানো চেতনাকে ফিরিয়ে আনার রাজনীতি বলবান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বাবার মতো রাজনীতিতে সাফল্য দেখাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শুরুতে কারও কারও মধ্যে সংশয় ছিল। রাজনীতি থেকে যিনি নিজেকে পিতার ইচ্ছায় দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তিনি পিতার রাজনীতির ধারা এগিয়ে নিতে পারবেন কিনা সে প্রশ্নও ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ হাসিনা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, তার ধমনীতে শেখ মুজিবের রক্ত বহমান, তাই তিনি পরাজয় মানতে জানেন না।
যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে মুজিব হত্যার বিচার হবে না, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে আর সবাই পরাজিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন তার সময়ের অন্যসব রাজনীতিকদের ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি তার সময়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। কাজটি অবশ্যই সহজ ছিল না। ঘরে-বাইরে বৈরিতা ছিল এবং আছে। সব মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার এক কৃতিত্ব শেখ হাসিনার।
বাংলাদের রাজনীতিতে অনেকগুলো নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উন্নয়নের দর্শন হলো- ‘রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে… রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতা হবে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে, সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে… কে কত ভালো কর্মসূচি দিতে পারে। কোন দলের কর্মসূচি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে বেশি ফলপ্রসূ জনগণ তা বিচার করার সুযোগ পাবে। আন্দোলন হবে সমাজ সংস্কারের জন্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। উন্নয়ন হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য এবং রাজনীতি হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সামাজিক অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি।‘
এই লক্ষ্য অর্জন সহজ নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশে খুবই কঠিন। রাজনীতিবিদরা সাধারণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার বাইরে থেকে যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা বলেন তা করেন। চাপ দিয়ে, আন্দোলনের নামে সহিংতা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় করা যায় না। তিনি যেটা সঠিক মনে করেন, সেটা বাস্তবায়িত করার জন্য যে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তিনি তা নিতে পিছপা হন না। তার গৃহীত পদক্ষেপ সবাইকে নিশ্চয়ই খুশি করে না। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে রাজনীতিতে একমত একপথ হয়ে চলা সহজ নয়। তবে শেখ হাসিনার হাত ধরে রাজনীতিতে অস্থিরতা অনেকটাই দূর হয়েছে। শেখ হাসিনাকে যদি সময় ও সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। তিনি পরপর তিনবার দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে তার রাজনৈতিক কৌশলের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনীতি মূলত নীতি ও কৌশলের খেলা। কৌশলে তিনি শতভাগ জিতেছেন। এখন নীতির রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় তার সাফল্য দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কমেছে দারিদ্র্যের হার। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রায় শেষ, জুন মাসেই এই সেতু উদ্বোধনের কথা। মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেলের মতো আরও বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সমাপ্তির পথে। রূপকল্প ২০২১- এরপর রূপকল্প ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর মতো দূরদর্শী কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার এগিয়ে যাওয়ার পথচিত্র তৈরি করেছেন।
ঢাকায় বসে সরকারের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্য শেখ হাসিনা বলেছেন, আগে বাংলাদেশটা ঘুরে আসেন। গ্রাম পর্যায়ে যান। সেখানে মানুষ কী অবস্থায় আছে একটু দেখে এসে তারপর কথা বললে ভালো হবে।
যারা চোখে দেখা সত্যকে মনের ভুল ভাবেন তারা স্বীকার না করলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক বদলেছে। তবে সমস্যা নেই বা আরও ভালো করার সুযোগ নেই তা অবশ্যই নয়। রাজনীতিতে সংঘাত নয়, গঠনমূলক সমালোচনা ধারা এবং ভালো কর্মসূচির প্রতিযোগিতা চললে দিন বদলের ধারা অব্যাহতই থাকবে।
লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার, জেষ্ঠ্য সাংবাদিক