ডেস্ক রিপোর্ট : সীমাবদ্ধতা আরও বেড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। আয়কর আইন-২০২৩ পাস হওয়ার কারণে এখন আর চাইলেই এনবিআরের কাছ থেকে কারও আয়কর নথি তলব করতে পারবে না সংস্থাটি। কোনও অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে আমলি আদালত আদেশ দিলেই কেবল দুদক রিটার্ন বা নথিপত্র চাইতে পারবে। এই আইন দুদকের জন্য মারাত্মক আঘাত বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ যুগোপযোগী করার অংশ হিসেবে গত ১৮ জুন ‘আয়কর আইন-২০২৩’ নামে একটি বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। ইতোমধ্যে সেটা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ আইনের অংশ-২১-এ ‘তথ্য সুরক্ষা’ শিরোনামে ৩০৯ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
দুদকের ক্ষমতা কমানো হয়েছে
এ ৩০৯ ধারার বিধানে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনও আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, এ ধারার বিধান সাপেক্ষে সব বিবরণ বা তথ্য গোপনীয় থাকবে এবং সেটি প্রকাশ করা যাবে না।’ ‘সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ বা অন্য কোনও আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট রিটার্ন বা রেকর্ড প্রজাতন্ত্রের কোনও কর্মচারী কর্তৃক উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান বা সাক্ষ্য-প্রমাণ তলব করতে পারবে না।’ ‘তবে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর অধীন কোনও অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে আমলি আদালত আদেশ করলে রিটার্ন বা রেকর্ড প্রদান করা যাবে।’ অর্থাৎ দুর্নীতির তদন্তের ক্ষেত্রে আয়কর সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র দুদককে পেতে হলে আমলি আদালতের আদেশ নিতে হবে বা থাকতে হবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় যা আছে
বিদ্যমান ব্যবস্থায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২০ ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা পেয়ে দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধানের সময় এ আইনের ১৯ ধারার বিধান অনুযায়ী চাহিদাপত্র বা রিকুইজিশন দিয়ে আয়কর সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সিআরপিসি), ১৮৯৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী তদন্তকালে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র জব্দ করে আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
দুদক কর্মকর্তারা যা বলছেন
আয়কর আইন-২০২৩-এর ৩০৯ ধারা সংযুক্ত হওয়ার কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তারা। যেমন অনুসন্ধানের সময় অনুসন্ধান কর্মকর্তা চাইলে আয়কর সংশ্লিষ্ট কোনও রেকর্ড বা তথ্য-উপাত্ত পাবেন না। তদন্তের সময় আয়কর সংশ্লিষ্ট রেকর্ড বা নথিপত্র পেতে প্রতিটি অভিযোগের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে আমলি আদালতে আবেদন করে রেকর্ড বা নথিপত্র সংগ্রহের জন্য অনুমতি নিতে হবে। এতে দুদকের ক্ষমতা খর্ব হওয়াসহ সময় ও অর্থ নষ্ট হওয়া ছাড়াও নানা জটিলতার সৃষ্টি হবে।
দুদকের এসব কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭ ধারার জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ, অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষ করে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আয় ও ব্যয় সংক্রান্ত দালিলিক রেকর্ডের স্বল্পতায় আয়কর রিটার্নকে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে কর্মকর্তারা বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দীর্ঘ জীবনের আয়-ব্যয় যোগ-বিয়োগ করে জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ আছে কি না নির্ধারণ করে থাকেন। অনুসন্ধানকালে আয়কর সংশ্লিষ্ট রেকর্ড না পেলে যথাযথ ও সঠিক তথ্যের অভাবে দুর্নীতিবাজরা ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। আবার অনেক নিরীহ ব্যক্তিও হয়রানির শিকার হতে পারেন।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া প্রতিবেদনে যা আছে
নতুন আয়কর আইনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়কর আইন-২০২৩-এর ৩০৯ (৩) ছ ও ৩০৯ (৩) জ ধারা অনুযায়ী মহা হিসাব-নিরীক্ষক বা তার নিয়োগকৃত কর্মচারী; ৩০৯ (৩) ঝ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্ম কমিশন; ৩০৯ (৩) থ ধারা অনুযায়ী মানিলন্ডারিং এবং সন্ত্রাসী অর্থায়ন সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউশন অনুমোদনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষসহ অন্যদের জন্য তথ্যপ্রাপ্তিতে কোনও বাধা না থাকলেও, তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্তে তথ্যপ্রাপ্তিতে ৩০৯ (১) ও ৩০৯ (২) এ যে বিধান করা হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। তবে আয়কর আইন-২০২৩-এর ৩০৯ ধারা সংশোধন করার প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। যেন আগের মতো অনুসন্ধান ও তদন্তকালে রিকুইজিশন দিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও জব্দ করা যায়।
৩০৯ ধারা দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭ ধারার জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতাধীন ঘুষ ও দুর্নীতিসহ সংশ্লিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত করা হয়। বাংলাদেশ ‘দি এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং’-এর সদস্য রাষ্ট্র। এ গ্রুপের সদস্য হিসেবে এফএটিএফ রিকমেন্ডেশন বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ আয়কর আইন-২০২৩-এর প্রস্তাবিত ৩০৯ ধারার দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তে আয়কর রেকর্ড সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে।
দ্য ব্যাংকার্স বুক অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৯১ দ্বারা দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে ব্যাংক ডকুমেন্ট পাওয়ার প্রতিবন্ধকতা থাকলেও পরে সেই প্রতিবন্ধকতা হাইকোর্টের আদেশে দূর হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি দমনে সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ২০০৪ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্য এ সংস্থার উদ্ভব। এ ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের পৃথক আইন দিয়ে দুদক আইনের ক্ষমতা খর্ব করা সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়।
দুদক একটি তদন্তকারী সংস্থা হওয়ায় আয়কর আইন-২০২৩-এর প্রস্তাবিত ৩০৯ ধারা প্রযোজ্য না হলেও তা সুনির্দিষ্টভাবে দুদককে তথ্য না দেওয়ার জন্য করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছেন, আয়কর আইন-২০২৩ প্রণয়নের মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতাকে আরও খর্ব করা হয়েছে। কারণ, এখন থেকে আদালতের আদেশ ছাড়া আর কোনও তথ্য পাবে না দুদক। ফলে ছোট-বড় দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার যে প্রত্যাশা দুদকের ছিল, সেটা ব্যাহত হবে।
তিনি আরও বলেন, দুদককে যারা অকার্যকর দেখতে চায়, তাদের জন্যও এটা একটা বড় সুখবর। এ আইন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতিরও বরখেলাপ।
ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্যে বলেছেন, দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টা এটাই প্রথম নয়। মানিলন্ডারিং আইন, ২০১২ একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়। ফলে দুদক যে ২৭টি অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাতে পারতো, সেটা থেকে মাত্র একটি অপরাধের তদন্ত করার ক্ষমতা রাখা হয়েছে। বাকি ২৬টি অপরাধের তদন্ত কার্যক্রম এখন অন্যান্য সংস্থার হাতে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন