নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি মো. জামিল হাসান। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা জামিল হাসান একসময় বরিশাল র্যাব-৮ এর অধিনায়ক ছিলেন। ২০২১ সালের মার্চে তিনি ব্যাটেলিয়নটিতে যোগ দেন। র্যাবে কর্মরত অবস্থায় জামিল হাসান বিশেষ অবদান রাখেন; যা বেশ আলোচিত হয়। বিশেষ করে বরিশালে মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশের এই কর্মকর্তা ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক- বিপিএম’ এবং ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক-পিপিএম’ পেয়েছেন।
চৌকশ এ কর্মকর্তা প্রায়শ:ই লেখালেখি করেন। ডাকাত সর্দার ’কালা ভাই’ কে নিয়ে তার একটি অসাধারণ লেখা তাঁর ফেসবুকের টাইম লাইনে পোস্ট করেছেন। বাস্তবধর্মী এ লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হুবহু তুলে ধরা হলো:-
মানুষের বয়স যত বাড়ে, ততই বাড়ে দিব্যজ্ঞান। চোর-ডাকাতও তখন দার্শনিকে পরিনত হয়।”
একবার কালাভাই (আসল নাম কেউ জানত না) নামের এক ডাকাত সর্দার আমাকে খুব বোকা বানাল।তখন গাজীপুরে সার্কেল এএসপি আমি। কয়েকটি বড় ফ্যাক্টরিতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটায় চাকরি প্রায় চলে যায় যায় অবস্থা। বাধ্য হয়ে একজনের মারফতে কালাভাইকে অনুরোধ করলাম আমার সাথে দেখা করে পরামর্শ ও সহযোগিতা দান করার। মনে মনে ইচ্ছা ছিল কালাভাইকে পেলেই আটক করে ফেলব। দুর্ধর্ষ দারোগা মদন মোহন বণিকের সাথে আলাপ করে প্ল্যান বললাম, সে একমত হল। কালাভাইয়ের শর্ত ছিল অনেকগুলো। আমাকে একা যেতে হবে, বড়জোর একজন লোক সাথে নিতে পারব। কোনরকম অস্ত্র সাথে নেয়া যাবেনা। তার লোকেরা আমাকে/ আমাদেরকে দেহ তল্লাশি করবে। সে যেখানে নামতে বলে সেখানেই গাড়ি থেকে নেমে তার প্রতিনিধির সাথে কথা বলে তাদের পরামর্শ মত যেতে হবে। কোন চালাকি করার চেষ্টা করা যাবেনা, ইত্যাদি।আমরা ভেবেচিন্তেই রাজি হলাম।
কথামতো সোর্সকে গ্যারান্টি হিসাবে ডিবি’র হাজতে রেখে আমি আর এসআই বণিক কোনাবাড়ি আমবাগে নেমে যখন পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।ডিবি’র একটা বড় দলকে বাসস্ট্যান্ডের অনেক দূরে গাড়িতে রেখে আমরা স্ট্যান্ড থেকে ডানদিকে ঢুকে দহ (বিরাট বিল) এর পাশের রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে অনেকক্ষণ হাঁটার পরে কালাভাইয়ের প্রতিনিধিদের সাথে দেখা হল। তাদের চারজন ছাড়াও আশপাশে আরও বেশ কয়েকজনকে অলস ভঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানের সামনে দাঁড়ানো দেখলাম। ধরেই নিলাম যে এরাও কালাভাইয়েরই লোক।
এসআই বণিক আগে ছিল, তার দেহতল্লাশীর সময়ে সে নিচুস্বরে তাদের সাথে কিছু আলাপ করে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে সার্কেল স্যার একজন বড় অফিসার, বিপদে পড়ে সাহায্য নিতে এসেছে কালাভাইয়ের কাছে। তার দেহ তল্লাশী করা বিরাট বেয়াদবি হবে।এত বড় অফিসারের কথা-কাজে ফারাক হয়না, ইত্যাদি। একজন ফোন করে কালাভাইকে বিষয়টা জানালে সে তল্লাশী করতে নিষেধ করল। অত:পর তারা আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে যেতে বলল। বরাবর যেতে হবে সামনের অনেক লম্বা উঁচু বাউন্ডারি ঘেরা শামসুল আলামীন গ্রুপের পরিত্যক্ত কারখানার পাশ দিয়ে। ঘড়ি দেখলাম রাত প্রায় সাড়ে আটটা।
শামসুল আলামীন গ্রুপের পরিত্যক্ত কারখানাটি বিরাট আয়তনের। দুই-তিনশ’ বিঘার কম হবেনা। আবছা আলোয় দেখলাম বেহোড়ের জঙ্গলের মত ঘন গাছপালা ও লতাগুল্মে ঠাসা বোঝাই। বুকের মধ্যে ধুঁকপুঁক করছিল আর ভাবছিলাম আজ এস্পার ওস্পার হয়ে যাক! আমার পরনে খুব ঢোলা একটা প্যান্ট এবং হালকা কেডস। দুই পায়ের গোড়ালির পিছনে কেডসের ভিতরে ব্যারেল ঢুকিয়ে আর বাঁট রাবার দিয়ে গোড়ালির সাথে আটকে নিয়েছি আমার এবং এসআই বণিকের দুটি পিস্তল। প্রয়োজনে এক লহমায় বের করে আনা যাবে।
কালাভাইয়ের লোকেরা কেউ সাথে এলোনা কেন সেটা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছিল আস্তে আস্তে হেঁটে সামনে যেতে হবে।সময়মত কালাভাই আমাদের ফোন করে থামিয়ে দেখা করবে।সে ফোন করার পরে কোনকারনেই কল কাটা যাবেনা তার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত।
অনেক লম্বা বাউন্ডারি, প্রায় দশফুট উঁচু।তার উপরে কাঁটাতারের বেড়া। ওপাশে অন্ধকার জঙ্গল। আরেক পাশে নদীর মত বড় দহ। আমাদের ডানে/বামে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। দেয়ালের মাঝামাঝি আন্দাজ যাওয়ার পরে ওপাশ থেকে একটি গুলির শব্দ পেলাম কিন্তু কোন ফ্ল্যাশ দেখা গেল না।কিছুটা ভীত এবং হতভম্ব হয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। জায়গাটা অন্ধকার। পিস্তল বের করে দু’জনেই চেম্বারে গুলি তুললাম। ঠিক তখনই আমার নাম্বারে ফোন এলো। তখন সবই ফিচার ফোন সেট।তাড়াতাড়ি রিসিভ করতেই একটা গম্ভীর কণ্ঠ শুনলাম।
স্লামালাইকুম স্যার, আমি কালাভাই।
তাড়াতাড়ি লাউডস্পিকার অন করে দিয়ে জবাব দিলাম।
ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছ কালাভাই?
কণ্ঠ নিশ্চিত হওয়ার জন্য এসআই বণিককে ইশারায় প্রশ্ন করলাম।সে নিশ্চিত করল যে এটা কালাভাইয়েরই কণ্ঠ।
উত্তর এলো, ভাল আছি স্যার।
বলেন, কি জন্য আমাকে ডেকেছেন?
: তুমি কোথায় এখন? দেখা করে কথা বলব না?
: এই তো আপনাদের পাশেই আছি স্যার। আমি আপনাদেরকে দেখতে পাচ্ছি।
আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম, তার মানে কি?
: স্যার আমি দেয়ালের এই পাশে আছি যাতে আপনি আমাকে ধরতে কিংবা গুলি করতে না পারেন।নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই তো আপনার সাথে দেখা করব, তাই না স্যার?
বুঝতে পারলাম কালাভাই কোনভাবে দেয়ালের ভিতরে ঢুকে গাছে চড়ে বসেছে এবং আমাদের দেখতে পাচ্ছে।কিন্তু এই অন্ধকারে আমাদের কিছুই আর করার নেই।
আবার বলল:
স্যার চালাকি করতে না করেছিলাম, তারপরেও আপনি সাথে অস্ত্র এনেছেন।এটা ঠিক করেন নাই।অবশ্য আমি বুঝতে পারছিলাম যে আপনারা অস্ত্র আনবেনই। কিন্তু আমি বেয়াদবও না, বিশ্বাসঘাতকও না। তাই সার্চ না করেই আসতে দিয়েছিলাম। যাই হোক এবার বলেন স্যার।
আমি তখন ভীষণ হতাশ। কথা বলার শক্তিই নেই যেন।আস্তে আস্তে বললাম
তুমিতো আমার চাকরি চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেছ।
: তোবা, তোবা, এসব কি বলেন স্যার! আমি কি করছি?
: কি করনাই? একের পর এক ডাকাতি আর চুরি করাচ্ছো।
: অস্তাগফিরুল্লাহ, আমি ডাকাতি করিনা স্যার। আগে করতাম।আগে ঘর চুরি ও করতাম।এখন তাও করি না।
: তাহলে তুমি এখন কি কর?
: স্যার আমার ২/৩টা দল আছে। তারা কোনাবাড়ি আর কালিয়াকৈর এলাকায় ফ্যক্টরিতে মেশিনপত্র চুরি করে।
: সেটাইতো বলছি আমি। মৌচাকের ফ্যাক্টরির ডাকাতিতে তুমি নিজেও ছিল। দারোয়ানের বর্ণনায় বোঝা যায়। বিশাল শরীর, অনেক দাড়ি আর সারা গায়ে ঘন পশম।এটাতো তুমি কালাভাই!
:জ্বী স্যার, আমিই।
: তাহলে যে বললা এখন আর কর না!
: বাধ্য হয়ে করেছি স্যার, অন্যকোন উপায় থাকলে করতাম না। ডাকাতির চেয়ে চুরি ভাল। ডাকাতিতে ঘর দরোজা ভাঙ্গে, মানুষ খুন হয়। শুধু যে সম্পদ লুট হয় তা নয়, অনেক সময়েই মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করে হারামজাদা পোলাপাইনে। আগে নিষেধ করে দিলেও শোনেনা।
: মৌচাক ফ্যাক্টরির মাল ফিরিয়ে দাও, কালাভাই।
নাহলে আমি তোমাদের পিছনে লাগব।তোমার পুরো দল নির্মূল না করে ছাড়ব না।
: মাল নারায়নগঞ্জে বন্দর থানার মধ্যে কোথাও বিক্রি হয়েছে স্যার, খুঁজে বের করে নেন গিয়ে।
: কত টাকায় বিক্রি হয়েছে? দাঁতে দাঁত পিষে বললাম।
: বিশ লাখ
: শুধু নামটা বল, অনুরোধ করছি।
: সব বলে দিলে আপনাদের কাজ কি স্যার? তাছাড়া তারা আমাকে টাকা দিয়েছে।এখন তাদের ধরিয়ে দিলে সেটা বিরাট বেঈমানী হবে।
: তোমার আবার ঈমানও আছে নাকি?
একটুও রাগ না করে জবাব দিল, অবশ্যই আছে স্যার। আপনি কথা দিয়েছিলেন অস্ত্র আনবেন না।কিন্তু দুইটা অস্ত্র নিয়ে আসছেন। আপনিই বিচার করুন ঈমান আমার না আপনার বেশি। আমার হাতে এখন পিস্তল আছে, অনেকগুলা গুলিও আছে।কিন্তু আপনাদের মারার আমার কোন দরকার নাই, তাই গুলি করি নাই।কিন্তু আপনি তো আমাকে দেখতে পারলে গুলি করে দিতেন।ঠিক বলেছি না বলেন স্যার?
উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম।
:স্যার এখন চলে যান।সাহায্য করার কথা ছিল করছি। মৌচাক ফ্যাক্টরির মাল কারা নিছে, কোথায় বিক্রি করছে, কত টাকায় বিক্রি করছে, সব আপনি এখন জানেন।গিয়ে খুঁজে বের করেন।
আর একটা কথা বলি স্যার।আমরা ডাকাতি করি ধনী হওয়ার জন্য না। ডাকাতি করে কেউ ধনী হয়ে যায় না। কখনও শুনছেন ডাকাতি করে কেউ ধনী হইছে কিংবা ফ্যাক্টরির মালিক হইছে? এই কাজ করতে করতে বয়স হয়ে গেছে।এখন অন্যকোন কাজ পারিনা।এটাও না করলে পরিবার, ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকবে। যা কামাই করি তা খাওয়া পড়া আর মামলাগুলোর খরচ চালাতেই শেষ।
যান স্যার, ভাল থাকেন। বড় চাকরি করেন। আল্লাহ আপনাকে আরও বড় বানাক।
স্লামালাইকুম স্যার।
আমরা ততক্ষণে হাঁটা শুরু করেছি।
……………………………………………………………………..
কিছুদিন পরের কথা। নারায়নগঞ্জের বন্দর থানাধীন একটি এলাকা থেকে ফ্যাক্টরির লুট হওয়া অধিকাংশ মালামাল পুলিশ উদ্ধার করে এবং দলবলসহ ডাকাতির প্রস্তুতি গ্রহণ করার সময়ে পুলিশি অভিযানে কালাভাই এবং মাসুম নামের দুই ডাকাত নিহত হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়, দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। দায়িত্ব পালন করতে আমাকে ঘটনাস্থলে যেতে হল। প্রথমবারের মত দেখলাম কালাভাই নামের দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দারকে। বিশাল দেহ, ঘন দাড়ি আর সারা গায়ে ঘন লোম। স্তিমিত আধভেঁজা দুই চোখের তারায় কি যেন একটা না বলা নালিশ ছিল তার।…….ডাকাতি করে কেউ ধনী হয়ে হয়ে যায় না……..পরিবার, ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকবে।
এ পৃথিবীতে কোন মানুষেরই সব কথা বলা হয়না। বিশেষত বেয়ারা পুরুষগুলো খুব সামান্যই বলে যেতে পারে। তারা কাঁদেনা, দীর্ঘশ্বাস ফেলেনা, শুধু নির্বাক নালিশ রেখে যায়।
সবার সব নালিশ বড় আদালতে গ্রাহ্যও হয়না। কিন্তু বোবা নালিশে স্বর্গের সিংহাসন কেঁপে উঠে।
ফেসবুক থেকে সগৃহীত: